রাষ্ট্র এবং তার বাহিনী
;
রিক্সা ভ্যানে শায়িত এই লাশটি ইনসেটের ১৪ বছর বয়সী শিশু ইয়াসমিনের, দিনাজপুরের ইয়াসমিন। ইয়াসমিন হচ্ছে বাঙলাদেশে পুলিশী অপরাধের বিভৎস, কদাকার এক কাহিনীর নাম। সেই সাথে পুলিশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের রুদ্ররূপ সংগ্রামের এক জ্বলন্ত ইতিহাস।
১৯৯২ সালে ইয়াসমিনের মা রিক্সাচালক স্বামীর মৃত্যুর পর অভাবের তাড়নায় ইয়াসমিনকে স্কুল ছাড়িয়ে (৫ম শ্রেণী) সেই শহরেরই এক ধনী ব্যক্তির (ঢাকার ধানমন্ডিতে বসবাসরত) বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজে দেয়। দীর্ঘ ৩ বছর যাবৎ শিশু ইয়াসমিন সেখানে কাজ করাকালীন সময়ে মাকে দেখার জন্য বার বার আকুতি জানিয়েও গৃহকর্তার হৃদয় গলাতে না পেরে ১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট পালিয়ে একাই দিনাজপুরের উদ্দেশে ঢাকা-ঠাকুরগাঁওগামী নৈশ কোচ হাছনা এন্টারপ্রাইজে উঠে পড়ে।
২৪ আগস্ট রাত ৩টার দিকে ইয়াসমিনকে হাছনা এন্টারপ্রাইজের সুভারভাইজার দিনাজপুরের দশমাইল মোড়ের পান দোকানদার জাবেদ আলী, ওসমান গনি, রহিমসহ স্থানীয়দের জিম্মায় দিয়ে সকাল হলে মেয়েটিকে দিনাজপুর শহরগামী কোনো গাড়িতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানান। কিছুক্ষণ পর দিনাজপুর কোতোয়ালি থানা টহল পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান ইয়াসমিনকে সেই রাতেই দিনাজপুর শহরে মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে জোরপূর্বক গাড়িতে তুলে নেয় এবং পথিমধ্যে পিকআপেই ধর্ষণের চেষ্টা করলে ইয়াসমিন পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পেতে গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু রক্ষা সে পায় না, আবারও তাকে পুলিশ জোরপূর্বক নিজেদের পিকআপে তুলে নিয়ে স্থানীয় আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভিতরে নিয়ে উপর্যুপরি গণধর্ষণ শেষে হত্যা করে লাশ গাড়িতে তুলে নিয়ে তা রাস্তার পাশে ছুড়ে ফেলে দেয়।
২৪ আগস্ট সকাল বেলা স্থানীয় লোকেরা ইয়াসমিনের লাশ রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখলে ঘটনা জানাজানি হয়ে যায়। এ পৈশাচিক ঘটনায় কর্তৃপক্ষ অপরাধীদেরকে শাস্তির আওতায় না এনে উল্টো তা ধামাচাপা দিতে “অজ্ঞাত পরিচয় যুবতীর লাশ উদ্ধার” মর্মে থানায় একটি ইউডি মামলা ফাইল করে। তড়িঘড়ি করে কোনো জানাযা ছাড়াই আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করে দেয়। স্থানীয় এক পত্রিকা সম্পাদক (দৈনিক উত্তরবাঙলা) পুলিশ কর্তৃপক্ষের এই জঘণ্য কার্যকলাপ সেই রাতে পত্রিকায় প্রকাশের উদ্যোগ নিলে কর্তৃপক্ষ তা জানতে পেরে তার ছাপাখানার বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়। সম্পাদক কৌশলে পাশের বাড়ি থেকে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করে তা পরের দিন প্রকাশ করে দিলে দিনাজপুরের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ বিক্ষুব্ধ মানুষের চিন্তা ভিন্নখাতে প্রবাহের জন্য ইয়াসমিনকে ভ্রাম্যমান পতিতা হিসাবে প্রচার করতে থাকে। এতে দিনাজপুরের মানুষ আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা থানা ঘেরাও ও আক্রমণ করে থানার প্রাচীর ভেঙে দেয়। শহরের অনেকগুলো পুলিশ ফাঁড়ি এবং পুলিশের গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ রূপ নেয় যে সমগ্র দিনাজপুরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং পুলিশের সাথে খালি হাতে যুদ্ধে নেমে পড়ে। এই ঘটনায় প্রায় ৭জন মানুষ নিহত হয়, শতাধিক আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করে। সমগ্র জেলার সরকারী নিয়ন্ত্রণ ভেঙে পড়ে। কর্তৃপক্ষ কারফিউ জারী করে, আধাসামরিক বাহিনী রাস্তায় নামায়। সারা দেশের মানুষ দিনাজপুরের মানুষের সাথে একত্বতা প্রকাশ করে কর্মসূচী ঘোষণা করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বহু ক্ষয়ক্ষতি শেষে তৎকালীন সরকার জনতার কাছে হার মানে এবং ঘটনার তদন্ত ও বিচার করার উদ্যোগ নিয়ে জনতাকে শান্ত করে।
২০০৪ সালে রংপুরের একটি আদালতে ধর্ষণ ও খুনের দায়ে সেদিন গাড়িতে থাকা তিন পুলিশ সদস্যের ফাঁসির রায় হয়। কিন্তু সেই ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা, আলামত নষ্ট করা এবং তার জের ধরে পরবর্তী ঘটনাবলীতে যে ৭জন মানুষ নিহত হয়েছিলেন, শতাধিক আহত ও অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছিলেন, সরকারী বেসরকারী সম্পত্তির ক্ষতি সাধিত হয়েছিল, তার কোনো বিচার হয়নি, সেই প্রশ্ন কেউ তোলেনি।
সেই থেকে বাঙলাদেশে প্রতি বছর ২৪শে আগষ্টকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসাবে ঘোষণা ও পালন করা হয়। কিন্তু আজও প্রায় প্রতিদিন ভয়ঙ্কর থেকে ভয়াবহতমরূপে নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ ও ধর্ষণ করে খুন ইত্যাদি চলমান, সামান্যতম কোনো পরিবর্তন নেই, বরং বর্তমান পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। বর্তমানে দিবস ঘোষণা হওয়া সত্বেও বাঙলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসটাও তেমন পালিত হয় না, চোখে পড়ে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন