লেখক মোহিত কামাল, সমাজ সচেতন লেখক। পেশায় ডাক্তার, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। মানুষের মনের সাথে তাই তার যোগাযোগ। নানান শ্রেণীর মানুষের মনের খোঁজ নিতে নিতে হয়তো তাদের মনের অন্ধকার কিছু দিকেরও খোঁজ পেয়ে যান। প্রতিটা মানুষের মনের সেই অন্ধকারের প্রভাব পড়ে সমাজেও। ডাক্তার-লেখক সাহেব এই অন্ধকার সহ্য করতে পারেন না। ডাক্তার-সত্ত্বার খুঁজে পাওয়া অন্ধকারকে আলোকিত করতে চেষ্টা নেন তার লেখক-সত্ত্বার সাহায্যে। তার লেখায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন সমাজের নানান অসঙ্গতি। সাথে থাকে সম্ভাব্য সমাধানের প্রস্তাবনা। সুস্মিতার বাড়ি ফেরা উপন্যাসটা তেমনই।
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের আগমন খুব বেশি দিনের না। অথচ এরই মাঝে এ দেশে মহামারীর মতো সংঘটিত হচ্ছে ইন্টারনেট-ভিত্তিক অপরাধ, যেগুলোকে বলা হয় সাইবার অপরাধ। হ্যাকিং, বুলিইং, হেইট স্পিচ সহ নানা ধরনের সাইবার অপরাধের মাঝে এই উপন্যাসের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে অনলাইন হ্যারাসমেন্ট।
উপন্যাসে হ্যারাসমেন্ট এর শিকার সুস্মিতা নামের এক মেয়ে, যাকে ব্ল্যাক মেইল করে তারই হবু স্বামী ফটোশপের সাহায্যে ছবি এডিট করে। বাদবাকি উপন্যাস এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সংশ্লিষ্ট ঘটনাপ্রবাহ। যেই অবস্থায় অনেক ভিকটিমই বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ, সেখান থেকে একটি পরিবারের ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম চিত্রিত হয়েছে পাতায় পাতায়।
লেখকের লেখায় আমার কাছে বরাবর মনে হয়েছে, খুব বেশি প্রেডিক্টেবল হয়ে যায়। এ কারণে পুরো বই মনোযোগ ধরে রাখাটা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এই উপন্যাসে পেছনের কাভারে যা অল্প কিছু কথা লিখা আছে, কিংবা আমি উপরের প্যারায় যা বললাম, তাতেই মূল কাহিনীর অংশ প্রায় পুরোটাই চলে আসে। সাথে পরেরটুকুর ধারণাও। এই ব্যাপারটা আমার কাছে লেখার বড় ধরনের দুর্বলতা বলে মনে হয়েছে।
প্রযুক্তি নিয়ে লেখার একটা বিপদ হচ্ছে প্রযুক্তি (কিংবা আরো ভালো করে বলতে গেলে প্রযুক্তির ব্যবহার-অপব্যবহার) খুব দ্রুতই পরিবর্তনশীল। হয়তো দেখা যায় কাল যে অপরাধটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে বখাটেরা করছিল, আজ সেটাই মহাসমারোহে রাষ্ট্র করে চলেছে। কিংবা কিছুদিন আগেই যে ছবি দেখেই ফেইক বলে বুঝা যেত, এরই মধ্যে সেটা এডিটের এমন সফটওয়্যার চলে এল, যার মাধ্যমে প্রফেশনাল কাজে আর এডিট বলেও বুঝার উপায় থাকে না। ছবির পাশাপাশি কণ্ঠস্বর, এমনকি ভিডিওও এডিট করে ফেলা যাচ্ছে দিন দিন। এক সময় মানুষ মিসকল দিয়ে কিংবা রঙ নাম্বারে কল করে আনন্দ পেত। এখন কলরেট কম থাকলেও বিকৃতদের বিকৃতির ধরন পরিবর্তনের কারণে সেটা কম দেখা যায়।
এই যে বিজ্ঞান এত আগাচ্ছে, তা মানুষের হাতে এক ধরনের অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। এই অস্ত্রের অপব্যবহার রোধে নৈতিকতার শিক্ষা ও চর্চার বিকল্প নেই। কিন্তু উপন্যাসে সেটাকে সমাধান হিসেবে খুব একটা সামনে আনেননি ঔপন্যাসিক। বরং সমাধান খুঁজেছেন আইনের কঠোর প্রয়োগে। অথচ বাংলাদেশে আরেকটি বড় সমস্যা আইন প্রয়োগকারীদের অসহযোগিতা।
অবশ্য এসকল সমস্যার সম্মুখীনও হয়েছে কাহিনীর কেন্দ্রী চরিত্র সুস্মিতা বা তার সাথের অন্যরা। এমনকি শেষাংশে এসে উল্লেখযোগ্য দুটি চরিত্রের মৃত্যুর মাধ্যমে অপরাধীচক্রের বেপরোয়াভাব ও ক্ষমতার কিছুটা ছায়া এসেছে। তাতে আরো বাস্তবধর্মী হয়ে উঠেছে কাহিনী।
রেটিং-৫/১০
বই রিভিউ
বইঃ সুস্মিতার বাড়ি ফেরা
লেখকঃ মোহিত কামাল
প্রকাশনীঃ প্রথমা
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১১২
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫০